মার্কিন নির্বাচনের মহারণ জয় করেছেন রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১৩২ বছরের রেকর্ড ভেঙে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় দফায় হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করবেন তিনি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রধান দুই প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর বিজয়মুকুট ট্রাম্পের মাথায়।
আগামী চার বছর যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতিসহ বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণে প্রভাব বিস্তার করবেন নবনির্বাচিত মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট। বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর দেশটির নতুন প্রেসিডেন্টের নীতি ও শাসনে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সম্পর্ক কেমন হবে, তা বুঝতে বিশ্ববাসীর নজর এখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। অতীত ইতিহাস এবং ট্রাম্পের বর্তমান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির তুলনা করে কোন ক্ষেত্রে কে কতটুকু সুবিধা পাবে, তা নিয়েই চিন্তিত সবাই।
ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে এবার বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। এই আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে তার মন্তব্য নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি করেছে।
ট্রাম্প এক্স বার্তায় লিখেন, ‘আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটি নৈরাজ্যকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন এমনটা কখনো হয়নি উল্লেখ করে ট্রাম্প আরও লিখেছেন, ‘কমলা ও বাইডেন বিশ্বজুড়ে এবং আমেরিকায় হিন্দুদের নির্যাতন করে আসছে। আমার প্রশাসন এলে আমরা ভারত ও আমার ভালো বন্ধু প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে আমাদের বৃহত্তর অংশীদারিত্ব আরও জোরদার করব।’ এই পোস্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে বিরুদ্ধাচারের পাশাপাশি ভারতের প্রতি ট্রাম্পের পক্ষপাতিত্ব নতুন করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পর্কের ভিত্তিতে বলা যায়, দ্বিতীয় দফায় নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার জয়লাভে চিন্তামুক্ত হয়েছে ভারত। কারণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উভয়ে ‘ভালো বন্ধু’ হিসেবেই স্বীকৃত। এদিকে শেখ হাসিনা আর নরেন্দ্র মোদিও ‘ভালো বন্ধু’ হিসেবে পরিচিত। উভয়পক্ষের ভালো বন্ধু মোদি আওয়ামী লীগের বর্তমান নড়বড়ে রাজনৈতিক অবস্থানের উন্নতিতে কোনো অবদান রাখতে পারবেন কি-না তা এখন সময়ের অপেক্ষা।
যদিও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নরেন্দ্র মোদির প্রভাবের ফলে এমন হবে না যে, ট্রাম্প হাসিনা সরকারকে আবার বসাতে চাইবে। তবে একইসাথে কূটনীতিকরা বলছেন, বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতি ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়। যেমন ভারতের কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা ঐতিহাসিক। কংগ্রেস বিদায় নিয়ে মোদি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিবিদদের মধ্যে উল্লাস দেখা গিয়েছিল। তারা ভেবেছিলেন শেখ হাসিনার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী মোদির খুব একটা জমবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি একচুলও নড়েনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কংগ্রেসের চেয়ে মোদির বিজেপি শেখ হাসিনার জন্য আরও বেশি ভূমিকা রেখেছে। রাজনীতিতে ঐকমত্যের ভিত্তিতেই ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকরা মনে করেন, হাসিনা সরকারের পতনের পেছনে আমেরিকার হাত রয়েছে। তাই দলীয় স্বার্থে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পকে নিয়ে আশাবাদী দলটির নেতাকর্মীরা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট হাসিনার পদত্যাগের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা না থাকলেও বাইডেনের সঙ্গে ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কতটা উষ্ণ, তা গত মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সাইডলাইন বৈঠকে স্পষ্ট হয়েছে। ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ধরে বাইডেনের ছবি দেখেছে বিশ্ব। একই সঙ্গে এই সরকারের মধ্যে ট্রাম্পকে নিয়েও কোনো নেতিবাচক বক্তব্য নেই।
অপরদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের মন্ত্রী এবং শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা গত চারবছর ধরেই নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযোগ ও সমালোচনায় সরব ছিলেন।
বাইডেন প্রশাসন শুরু থেকেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে সক্রিয়। দেশটির কর্মকর্তারা স্পষ্ট করেছেন, বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভারতের দৃষ্টিতে দেখে না। সর্বশেষ শেখ হাসিনাও তার সরকারের পতনের জন্য ষড়যন্ত্রের তীর যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই ছুঁড়েছেন।
মার্কিন নির্বাচনের আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় শেখ হাসিনা ও তার দলীয় এক কর্মীর কথোপকথন। সেখানে একপর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।
এরপর বুধবার (৬ নভেম্বর) নির্বাচনে জয় লাভের ঘোষণা দেওয়ার পর এক বিজ্ঞপ্তিতে ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানায় আওয়ামী লীগ। দলটির দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে শেখ হাসিনা ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প এবং মেলানিয়া ট্রাম্পের সঙ্গে তার প্রথম প্রেসিডেন্সির সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার বিভিন্ন সাক্ষাৎ ও সাক্ষাৎকারের স্মৃতি স্মরণ করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, তার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সির অধীনে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও মজবুত হবে। উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক স্বার্থকে এগিয়ে নিতে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করেন তিনি।
সম্প্রতি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রায় ৭৬ বছরের পুরোনো এই সংগঠনটি ক্রমেই আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। দলের একটি অঙ্গ সংগঠন অচল হওয়ার পর ট্রাম্পের সাথে উভয়দেশের স্বার্থকে এগিয়ে নিতে একসঙ্গে কাজ করার যে প্রতিশ্রুতি শেখ হাসিনা প্রকাশ করেছেন, তা আদৌও কার্যকর হবে কি?
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের পক্ষে-বিপক্ষে খুব বেশি কিছু যায় আসে না। কারণ সরকার পরিবর্তনে হোয়াইট হাউজের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন হয় না। ফলে এই নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে ভাববার অবকাশ নেই।
তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, সবকিছুর পরও ব্যক্তিগত ভূমিকা যে একেবারে কাজ করে না, তা নয়। সেক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বাংলাদেশের জন্য কী অপেক্ষা করছে, তা হয়তো ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসায় ইউনূস সরকারের সাথে মার্কিন প্রশাসনের এই সুসম্পর্ক নাও থাকতে পারে বলে মনে করেন তারা।
এ সম্পর্কে সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে কূটনীতিক সাকিব আলি বলেন, ‘উনি (ট্রাম্প) যে সব উল্টে দেবেন তা আমি বলছি না। তবে বুঝতে হবে এই এলাকায় এখন বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মুখোমুখি হয়ে গেছে। ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তার পরিবর্তন হবে। মোদি ফ্যাক্টর কাজ করবে। কারণ ট্রাম্প আর মোদির মধ্যে সম্পর্ক অনেক ভালো। তাই বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে।’
ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে ট্রাইবুনাল। সে ক্ষেত্রে দেশে আসা মাত্র বিচারের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। গণহত্যার অভিযোগে এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কয়েকশত হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এই অবস্থায় ট্রাম্পের জয় নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও শেখ হাসিনা আশাবাদী হলেও তাদের রাজনৈতিক অবস্থান পুনরুদ্ধারে বিশেষ কোন উপকার হবে কি না, তা অনেকাংশেই নির্ভর করছে মোদি এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের সুসম্পর্কের ওপর। এক্ষেত্রে ‘শেখ হাসিনার বন্ধু ভারত’ আর ‘ভারতের বন্ধু ট্রাম্প’- এই সম্পর্কের জোরে আওয়ামী লীগ ট্রাম্প কার্ডের মতো সুবিধা পাবে কি না- সে প্রশ্নের উত্তর সময়ই কেবল দিতে পারে।
এসএবি