Logo
Logo

জীবনানন্দ

লালন কী জাত সংসারে

Icon

মামুনার রশীদ

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৭:০৪

লালন কী জাত সংসারে

লালন কে ছিলেন বা কী ছিল তার পরিচয়? এ সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। জীবদ্দশায় লালনকে এই প্রশ্ন করলে তিনি বলতেন,

‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।।

লালন কয় জাতের কী রূপ

আমি দেখলাম না দুই নজরে।

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।।

কেউ মালা’য় কেউ তছবি গলায়,

তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়

যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়

জাতের চিহ্ন রয় কার রে

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।।


যদি ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান,

নারীর তবে কী হয় বিধান,

বামণ চিনি পৈতা প্রমাণ,

বামণি চিনে কিসে রে

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।।


জগত বেড়ে জেতের কথা,

লোকে গৌরব করে যথা তথা

লালন সে জেতের ফাতা ঘুচিয়াছে সাধ বাজারে

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।’

হিতকরী পত্রিকার নিবন্ধের শেষে উদ্ধৃত হয়েছিল এই গানটি। 

তাঁর সেই উত্তর আজও লালনের সেরা গান হিসাবেই বিবেচিত। তবে ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে তাঁর কোনো বাজে ধারণা কখনোই পাওয়া যাইনি যদিও তিনি কোনো ধর্মমতেই জীবন পরিচালনা করেননি। মৃত্যুকালে কোনো সম্প্রদায়ী মতানুসারে তাঁর অন্তিমকার্য সাধিত হয়নি। তাঁর উপদেশ অনুসারে আখড়ার একটি ঘরের ভেতর তাঁর সমাধি হয়েছে।

পহেলা কার্তিক বাউল সম্রাট লালন ফকিরের তিরোধান দিবস। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু নিয়ে ইতিহাসবেত্তা ও লালন গবেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। তবে অধিকাংশ তথ্যবহুল গবেষণামতে তাঁর জন্ম ১৭৭৪ সালে কুষ্টিয়া শহরের পার্শ্ববর্তী কালীগঙ্গা নদীর ধারে ছেঁউড়িয়া গ্রামে। কালজয়ী এই সাধক ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর বাংলা পহেলা কার্তিক ভোর পাঁচটায় মৃত্যুবরণ করেন বলে সেই সময়ের 'হিতকরী' পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। তখন হিতকরী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কুষ্টিয়ার সূর্য সন্তান ‘বিষাদসিন্ধু’ রচয়িতা স্বনামধন্য লেখক মীর মশাররফ হোসেন। লালন ১১৬ বছর জীবিত থেকে অসংখ্য গান রচনা করেন এবং অসংখ্য মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। আজও তাঁর শিষ্যরা তাঁর তিরোধান দিবস উপলক্ষে প্রতিবছর পহেলা কার্তিক সেই ছেঁউড়িয়াতে সমবেত হন এবং লালন সঙ্গীতের মূর্ছনা ছড়িয়ে দেন। 

লালন বাউল না ফকির-- এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব,আলোচনা-সমালোচনা কম নেই। কেউ তাঁকে বাউল বলে, কেউ তাঁকে লালন ফকির বলে, কেউ বা বলে লালন শাঁই। এ ব্যাপারে লালন জীবন ও দর্শন নামক বইয়ে লেখক মোস্তাক আহমাদ বলেন, ‘সব বাউল দরবেশ নয়, আবার সব দরবেশ বাউল নয়। লালন ছিলেন দীক্ষার দিক থেকে দরবেশ কিন্তু সাধনার দিক থেকে বাউল।’ বাউল শব্দটি এসেছে বাচুল থেকে -হিন্দিতে বাচুল থেকে বাউলা। যেমন বৈজু বাউলা। এরা সমাজে থাকে না, এরা গৃহী নয়। এদের সম্পত্তি থাকে না, সন্তান জন্ম দেন না। দিনভর গান গেয়ে বেড়ান, রাতে আখড়ায় মিলিত হন। বাউল শব্দের অর্থ ‘বাউরা’,‘বাতুল’-- পাগল অর্থবোধক শব্দ থেকে এসেছে বাউল কথাটা। সুতরাং, এ আলোচনায় দেখা যায় লালন বাউলও বটে। পাগল বটে বাউলরা। পাগল হয়ে খুঁজেন তাঁদের মনের মানুষকে। বাউলরা মানেন না জাতপাত, ধর্মভেদ। 


অনেকে তাঁকে লালন ফকির বলেন কিন্তু তিনি ফকির নন কারণ সব ফকির যেমন বাউল নয় তেমনি সব বাউলও ফকির নয়।তবে সাধারণত মুসলিম বাউলরা ফকির। কোনো কোনো হিন্দুকে ফকির বলা হয়েছে। তাঁর জীবদ্দশায় ১৮৭২ সালে আগস্ট মাসে 'গ্রাম বার্তা' পত্রিকার 'জাতি' নামে একটা লেখা বের হয় এবং এ লেখায় ছিল,' লালন শাহ নামে এক কায়স্থ আর এক ধর্ম আবিষ্কার করেছে। হিন্দু -মুসলিম সকলেই এই সম্প্রদায়ভুক্ত। এরা কোনো জাতিভেদ স্বীকার করে না।' এ লেখায় লালনকে বাউল বা ফকির বলা হয়নি, বলা হয়েছে এক উদারপন্থি ধর্মের আবিষ্কারক। তবে তাঁকে লালন শাহ বলা যেতেই পারে। লালনের গুরুর নাম ছিল সিরাজ শাহ দরবেশ। তাঁর কাছে দীক্ষা নিয়েই লালন হয়েছিলেন লালন শাহ। শাহ একটি ফরাসি শব্দ যার অর্থ মহারাজা। শাহ থেকে শাঁই কথাটি এসেছে। শাঁই অর্থ স্বামী, প্রভু, মালিক, ভূস্বামী আর স্বামী শব্দের সংস্কৃত হলো স্বামিন। সুতরাং, লালন ফকির না বলে, লালন দরবেশ না বলে, লালন শাহ বলা তাৎপর্যপূর্ণভাবে ঠিক বলেই প্রতীয়মান হয়। লালন নামটি দিয়ে তাঁকে হিন্দু বা মুসলিম কোনোটাই বোঝা যায় না। কারণ লালন শব্দটি এসেছে লল্লন থেকে যার অর্থ লাল বা প্রিয়পুত্র। তিনি তাঁর সৃষ্টি ও সাধনা দ্বারা প্রমাণ করে গেছেন যে তিনি বাঙালির প্রিয়পুত্র। তিনি জাতপাতের বিরুদ্ধাচরণ করে গেয়েছিলেন সেই বিখ্যাত গান,

‘জাত গেল,জাত গেল বলে

এ কী আজব কারখানা,

সত্যের পথে কেউ নয় রাজি

সবই দেখি তা না না না।’


এই লালনকেই কিন্তু বিধর্মী বলে সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। কোনো এক সময় লালন সঙ্গী সাথীদের নিয়ে গঙ্গাস্নান করতে গিয়েছিলেন কিন্তু হঠাৎ তিনি বসন্তরোগে আক্রান্ত হন। তখন বসন্ত ছিল সংক্রমণ ব্যাধি। প্রাণভয়ে সঙ্গীরা অজ্ঞান, অচৈতন্য লালনকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে এসে গ্রামে তাঁর পরিবারকে জানিয়েছিল যে লালন মারা গেছেন। এদিকে মুমূর্ষু লালনকে নিয়ে গিয়ে সেবাযত্ন করেছিল এক মুসলিম নারী। সুস্থ হয়ে গ্রামে ফিরে এলে সমাজের ভয়ে লালনের বউ, মা কেউ তাঁকে ঘরে আশ্রয় দেয়নি। কারণ লালন মুসলিম ঘরের অন্নজল স্পর্শ করেছে। তখনকার দিনে মুসলিম ঘরের অন্নজল স্পর্শ করলে তার জাত যেত এবং এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করারও কোনো বিধান ছিল না। ধর্মের কারণে স্ত্রী, পরিবার ত্যাগ করতে হয়েছিল এবং সেই কারণেই ধর্মের অনুশাসনের বিরুদ্ধে তিনি মানবতার গান গেয়েছেন সব সময়।

তিনি মানব প্রেমের গান গেয়েছেন এভাবে,

‘মানুষ ছাড়া স্রষ্টার কোনো দলিল নাই

আদমরূপে কে কথা কয়

কলবের ভেতর তাই জানা যায়

সে তো স্বয়ং রুহ ফুকায়ে সর্বভূতে মিশে আছে।’

বেদ, পুরান যা পারে না, মানুষ তা পারে। মানুষই মানুষকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিতে পারে। ধর্ম দিয়ে মানুষের আচরণ নয় বরং মনুষ্য হবে মানব আচরণের মূলমন্ত্র। তিনি আরেক জায়গায় গাইলেন,

‘মানবরূপে সেই দয়াময়

তাই তো মানুষ ভজিতে হয়

মানুষ তত্ত্ব ভুলিয়া হায়

লালন ফকির মরে ঘুরে...’

তাঁর জীবন দর্শন ধর্ম নয়, মানুষ। তবে তিনি তাঁর কোনো সৃষ্টিতে ধর্মকে তুচ্ছজ্ঞান করেননি। তাঁর মতো করে মানবতার গান গেয়েছেন আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও। তিনি বলেন,

‘মিথ্যা শুনিনি ভাই

মানব হৃদয়ের চেয়ে চেয়ে বড় কোনো মন্দির কাবা নাই।’

অথচ আমরা আজ মন্দিরে দেবীর বেদিমূলে কোরআন রাখি, কেউ বা তার প্রতিবাদে মুখর হয়ে সেই মন্দির ভাঙি এবং কাবা, মন্দিরের চেয়েও বড় মানুষের মনে আঘাত দিই, মানুষকে হত্যা করি শুধু ধর্মের মান বাড়াতে। মানুষকে হেয় করে, মানুষকে হত্যা করে, মানুষের হৃদয়ে কষ্ট দিয়ে কোনো ধর্মই কখনো বড় হতে পারে না। বরং নিজ ধর্মকে হেয় করতেই আমরা হৃদয় ভাঙার মিছিলে নেমেছি। এ ক্ষেত্রে নজরুলের একটা কবিতার পঙ্‌ক্তি উল্লেখ করতে পারি,

‘মূর্খরা সব শোনো 

মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’


হিন্দু-মুসলিমের এই দ্বিধা দ্বন্দ্ব শেষ হোক। 

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর