অন্ধকার ছাদে হাঁটাহাঁটি করছে আসিফ। আজ কিছুটা অস্থির সে।
তনু আজ তাকে বিশেষ কিছু বলবে। তাতেই এই অস্থিরতা। অথচ এই সামান্যতে এমন টেনশান করার কোনো মানে হয় না। সন্ধ্যার পর পর সে ছাদে
চলে এসেছে। তনুও আসবে।
খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালে বেশ লাগে। মনে হয় এক পশলা ভালো লাগা টুপ করে মনের ভেতর ঢুকে যায়।
এত উঁচু উঁচু বাড়ি ঢাকা শহরে। দুর্গের মত দেখায়। গা ঘেঁষাঘেঁষি অবস্থা। তারপরও ছাদে এলে স্বস্তি লাগে। এই বাড়ির ছাদ পাঁচতলা। মিরপুরে নতুন এসেছে আসিফ। আগে থাকত রাজাবাজার। নতুন জায়গায় শিফট করলে অ্যাডজাস্ট করা কঠিন হয়। এলাকায় পরিচিতি হতে সময় লাগে। চেনা মানুষগুলোকে চোখে পড়ে না। এটাই অনেক।
সে তনুকে কল করল আবার। রিসিভ হয়নি।
সিঁড়িতে আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে । সম্ভবত তনু আসছে।
আসিফ রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। কিন্তু তনু রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াতে পারে না। তার হাইট ফোবিয়া আছে।
তনু এলো। আজ সে সবুজ কামিজ পরেছে। সবুজ রং শান্তিদায়ক। দেখলেও ভালো লাগে। ইদানীং তার সবুজ রঙে আসক্তি বেড়েছে।
বেডশিট জানালার পর্দা তোয়ালে সব সবুজ কিনছে।
আসিফ ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল।
তনু আই এ্যাম সরি।
এখানে সরি বলার কিছু হয়নি। সব ভাগ্য। আল্লাহ আমাকে এমন ভাগ্য দিয়ে পাঠিয়েছে।
তনু সব ভুলে যাও প্লিজ। আমি তোমাকে...
আসিফ কথা শেষ করতে পারল না। তনু আটকে দিলো।
আমার বাবু নেই। এটা আমি ভুলে যাবো?
তনু কাঁদছে। খুব নিঃশব্দে। আসিফ চুপ রইল। নিঃশব্দ কান্নার অর্থ বড় করুন। কেমন জানি অভিশাপের মত।
তনু চোখ মুছল না।
সে আসিফের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।
তনু সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমাকে সান্ত্বনা দিও না। আমি সব বুঝি।
কিছুই বোঝো না তুমি। কতবার তোমায় বলেছি বাবুটা পেটে। ওকে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙো না। কিন্তু তুমি তাই করলে। আমাকে কল করতে, চলে আসতাম আমি।
তনু হাসল। খুব ছোট্ট করে।
এই বাবুটা তিন মাস পাঁচ দিন আমার পেটে ছিল। এই তিন মাস পাঁচদিনে ও কিন্তু আমাকে একবারও বলেনি, মা তুমি দেখো তো বাবা কোথায়।
আসিফ ভয় পেলো। অন্ধকারে তার গা শিউরে উঠেছে।
সে লজিক পাচ্ছে না কী বলবে। তবুও বলল।
তুমি বেশি চিন্তা করছো তনু তাই এমন উল্টাপাল্টা বলছো।
আমি ঠিকই বলছি আসিফ। তুমি যেদিন চারতলায় সায়মার ফ্লাটে গেলে আমি কী করে টের পেলাম বলো তো? তারপর ছুটতে ছুটতে আমি তিনতলা পেরিয়েছি। তখনও আমি বিশ্বাস করতে পারিনি তুমি কতটা দুরে চলে গেছো।
আসিফ তনুকে কাছে টানল। কিন্তু তনু এলো না।
আমাদের তিন বছরের সংসারে এমন ঘটনা দুইবার ঘটেছে। প্রথম বাবুটা ছিল তিনমাস দশদিন। সেদিনও একটা ফোনকল এসেছিল আমার কাছে। তুমি সেদিন গাজীপুর গিয়েছিলে অফিসের কাজে। কিন্তু আমি জানলাম তুমি গাজীপুর যাওনি। তুমি শ্রাবণী নামের একজনকে নিয়ে রিসোর্টে গিয়েছো। আমি বিশ্বাস করিনি। তারপর তোমাদের ছবি দেখলাম। আর সবকিছু আমার কন্ট্রোলের বাইরে চলে যায়। সেদিনও বাবুটা আমায় চুপিচুপি বলেছিল, মা বাবাকে শক্ত করে ধরে রাখো।
তনু কেঁদে ফেলল।
এরা দুজনেই মনে হয় অদ্ভুত এক ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু তুমি এদের মেরে ফেলেছো।
তনু শান্ত হও। আমার কথা শোনো। যাই ঘটেছে এখানে তোমার আমার কোনো হাত নেই। তোমার মিসক্যারেজ হয়েছে এটা খুব সিম্পল বিষয়। এমন হচ্ছে তো অহরহ।
তনু কান্না থামালো। তবুও ফুঁপিয়ে যাচ্ছে।
কিছুই সিম্পল কারণ না। সব ঘটেছে তোমার কারণে। তখনও আমি বুঝিনি তুমি ভিন্ন এক মানুষ। যে মানুষটা আমার শরীরের বাইরে অন্য কারোর শরীরের স্পর্শে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তুমি সায়মার কাছে রোজ যেতে। কিন্তু আমাকে মিথ্যে বলতে। তুমি শ্রাবণীকে নিয়ে সুলতান রিসোর্টে রাত কাটিয়েছ। সেদিনও মিথ্যে বলেছো। এরপর হয়ত সুহাকে নিয়ে সমুদ্রে ঘুরে আসবে। তখনও মিথ্যে বলবে।
আসিফ চুপসে গেছে। তবুও কোনরকমে বলল-
আমি সরি তনু।
আসিফ তুমি কখনও ভালো হাসব্যান্ড হতে পারবা না। ভালো বাবাও না। কিন্তু আমি ভালো মা হতে চাই।
তনু আমি সব শুধরে নিবো।
তুমি কী করবে না করবে সেটা তোমার বিষয়। কিন্তু আমি মনে হয় তোমার সাথে আর থাকছি না।
আসিফ চমকে গেলো। অন্ধকারে তনুকে খুব অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে অনেক দূরের কেউ।
ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে সিঁড়িতে। তনু নেমে যাচ্ছে। একাই। কিন্তু আসিফ নড়ল না। তার মাথার উপর খোলা আকাশটা কেমন করে যেনো ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।