কবিতার গুণগান করতে গিয়ে বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক কবি ও দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়।’ বিখ্যাত এই পঙ্ক্তি থেকে আমরা সহজেই কবিতার গায়ে লেপ্টে থাকা লাবণ্যের কিছুটা সন্ধান পেতে পারি। তবে সার্থক কবিতার আবেদন নিঃসন্দেহে আরও বেশি। তাই একটি সার্থক কবিতার শরীরতন্ত্র কেমন হওয়া উচিত এ বিষয়ে আলোচনার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের। কবিতার একজন নিবিষ্ট পাঠক হিসেবে এও আমার এক ধরনের অধিকার বৈকি। কেউ কেউ অবশ্য রসিকতা করে বিলাসিতাও বলতে পারেন। কারণ আমি মূলত একজন একনিষ্ঠ পাঠক থেকে শখের লেখক। এই যে পাঠক থেকে ধীরে ধীরে লেখক হয়ে ওঠার গল্প, এর একটি বিশেষ সুবিধাজনক জায়গা আছে। কিছু দায়-দেনা আছে। নিজের লেখক সত্তার পাশাপাশি পাঠক সত্তার প্রতি অপরিমেয় ভালোবাসাবাসি আছে। পাড়াগাঁয়ের মেঠোপথের মতোই বিভিন্ন লেখকের লেখায় একান্তে ভ্রমণ করার মতো চাকচিক্য আছে। চিত্ত এবং বিত্তের মধ্যে ফারাক সৃষ্টিকারী অনুভব আছে। সম্পত্তি ও সম্পদের মালিকানা নিয়ে মহাকাব্যিক সুড়সুড়ি আছে। যাক এসব অজৈব বিষয় নিয়ে আর তেমন একটা আওড়াতে চাই না। এবার আসল কথায় আসা যাক। তবে তার আগে সার্থক কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে যৎসামান্য আলোচনা না করলেই নয়। তাহলে আলোচ্য বিষয়টি জীবন্ত হয়ে উঠবে বলে আমার গভীর বিশ্বাস।
মহাবিশ্বের প্রায় সবকিছুর মতোই সার্থক কবিতার সংজ্ঞাও আপেক্ষিক। কেননা ভালোলাগা, মন্দলাগা বিষয়টি আপেক্ষিকের চেয়েও আপেক্ষিক! তা না হলে পৃথিবীর সব মেয়েরা যেমন একজন ছেলেকে ভালোবাসতো; তেমনি সব ছেলেরাও একজন মেয়েকে ভালোবাসতো! কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। ঘটবেও না। কারণ একেকজনের চোখে একেকজন সুন্দর। কবিতার ক্ষেত্রেও বিষয়টি ঠিক তেমনি। প্রবাদে আছে, নানা মুনির নানা মত! আমার কাছে এই কবিতা ভালো লাগলেও অন্যজনের কাছে ভালো নাও লাগতে পারে। আর এটাই স্বাভাবিক বিষয়। এই যেমন এমন কিছু বিষয় বা প্রস্তাবনা থাকে; যাতে অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে একই মতামত পাওয়া যায়। তেমনি কিছু কিছু কবিতাও এমন আছে যা বোদ্ধা পাঠক মহলের গণ্ডি ছাড়িয়ে গণমানুষের হৃদয় জয় করে নেয়। এই সব কবিতাকে সাধারণত কালোত্তীর্ণ বা কালজয়ী কবিতা বলা হয়। এই কবিতাগুলো কালের পর কাল সাহিত্যে ঠিক থাকবে। এ বিষয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান কবি পার্সি বিশি শেলির কবিতা বিষয়ক একটি সংজ্ঞা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘কবিতা পরিতৃপ্তির বিষয়। কবিতা তখনই সার্থক হয়, যখন কবি মনের পরিতৃপ্তিতে পূর্ণতা আসে।’ তাঁর ভাষায় বোঝানো হচ্ছে, কবিতা হলো মানুষের পরিতৃপ্তির বিষয়। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের বিবরণ হচ্ছে কবিতা। শেলির এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেকেই সহমত প্রকাশ করেছেন এবং এটি বেশ গ্রহণযোগ্য। তবে কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে পরিপূর্ণ নয়।
সার্থক কবিতার শরীরতন্ত্রের কথা যদি বলি, তাহলে সর্বাগ্রে বলতে হবে শব্দের কথা। এই শব্দই হল কবিতার প্রাণ ভোমরা। শব্দের যথাযথ ব্যবহারের উপরই কবিতার লাবণ্য যথেষ্ট মাত্রায় নির্ভরশীল। কবিতার সার্থকতা অনেকাংশে নির্ভর করে। তাই কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের যথার্থতা অপরিসীম। এই শব্দেরা আবার বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। এই যেমন অপরিহার্য শব্দ, তাৎপর্যময় শব্দ, ব্যঞ্জনাময় শব্দ, উপমান এবং উপমিত শব্দ ইত্যাদি। যারা কবিতার গতি-প্রকৃতি, ভাব, ব্যঞ্জনা ইত্যাদি গভীর ও সার্থকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই কবিতায় শব্দ প্রয়োগ করতে হবে অত্যন্ত সাবধানে এবং সচেতন ভাবে। শব্দই কবিতার ভাব-কে প্রাণদান এবং গতি সঞ্চার করে। অহেতুক শব্দ বা মেদ কবিতায় ব্যবহৃত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
কবিতার যথার্থ শব্দের ব্যবহার নিশ্চিত করার পরই আসে বাক্যালংকার। এই বাক্যালংকারই হল কবিতার মূল চালিকাশক্তি। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যেমন খুশি বাক্য ব্যবহার করে থাকি। কোনো বিশেষ চিন্তা ভাবনা করি না৷ কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে মুখে বলা এবং কবিতায় বলা এক কথা নয়। সার্থক কবিতার জন্য সার্থক বাক্য অপরিহার্য। বাক্য গঠনজনিত ভুল থাকলে সার্থক কবিতা লেখা কোনোদিনই সম্ভব নয়। একটি সার্থক বাক্যের আবশ্যিকভাবেই তিনটি গুণ থাকা বাঞ্ছনীয়। এই যেমন- আকাঙ্ক্ষা, আসক্তি এবং যোগ্যতা। এই তিনটি গুণের কোনো একটির অভাবে বাক্যটি ত্রুটিপূর্ণ থেকে যাবে। আর ত্রুটিপূর্ণ বাক্যের কবিতা সার্থক কবিতা হয়ে উঠবে না এটা বলাই বাহুল্য। এই যেমন: পাখি আকাশে উড়ে না বলে যদি আমরা বলি গরু আকাশে উড়ে তাহলে বাক্যটি নি:সন্দেহে যোগ্যতা হারাবে।
শব্দের যথার্থ ব্যবহারের পরেই আসে কবিতার ভাব বা চিত্রকল্প। এ ক্ষেত্রে কবিতার ভাব অবশ্যই সার্বজনীন হওয়া উচিত। ব্যক্তিকেন্দ্রিক লেখা হলেও তা এমনভাবে উপস্থাপন করা উচিত যাতে করে কবিতায় ব্যবহৃত চিত্রকল্পটি প্রায় সকল পাঠকের জীবনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। পাঠকের দিব্য চোখের সামনে চিত্রকল্পটি ভাসতে থাকে। যদি এমন না হয় তাহলে কবিতার আবেদন পাঠকের হৃদয়ে নাড়া দিতে ব্যর্থ হবে। মূলত চিত্রকল্প পাঠককে দৌড়ের ঘোড়ার মতন এক মোহময় স্বপ্নিল আবেশে তাড়িত করবে। ভাবাবেগে হৃদয় মন মনন আন্দোলিত করবে। তবে কবিতার সার্বিক চিত্রকল্পের পাশাপাশি শব্দকল্পও যথার্থ হওয়া উচিত৷ তাতে করে পাঠক শব্দে শব্দে ভাবনার এক বর্ণিল জগতে ঘুরে আসতে পারে। শব্দের রূপ, রং, রস এবং স্পর্শে পাঠক মন সদা ভিন্ন আমেজের স্বাদ পায়।
সার্থক কবিতার আরও একটি বিশেষ গুণ বৈশিষ্ট্য হলো, ছন্দ এবং ছন্দরীতি। আমরা যারা কবিতা লিখি তারা অনেকেই কম-বেশি ছন্দের অক্ষর জ্ঞান জানা আছে। আবার অনেকে এমনও আছেন যে ছন্দ এবং ছন্দরীতি সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। তবুও বছরের পর বছর কবিতা লিখে যাচ্ছেন। কোনোদিন জানার চেষ্টাও করেননি। প্রকৃতপক্ষে ছন্দের ন্যূনতম জ্ঞান ছাড়া একটি সার্থক কবিতা লিখতে পারা সহজ কাজ নয়। বাংলা সাহিত্যে আজ পর্যন্ত যতগুলো কবিতা সার্থক হয়েছে; প্রতিটি কবিতা পড়ে দেখুন অবশ্যই কোনো না ছন্দের মধ্যে পড়ে। কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত বা মিশ্রবৃত্ত যে কোনোটির মধ্যে পড়বেই। মূলত ছন্দজ্ঞানে জ্ঞানী কবির কবিতাও সমৃদ্ধ হবে, ধনী হবে এটা অনায়াসেই বলে দেওয়া যায়।
কবিতার যথার্থভাবের স্ফুরণ এবং পাঠকের ভাবনায় ভিন্নমাত্রা আনয়ন করার জন্য আমরা সাধারণত উপমা, অলংকার, অনুপ্রাস ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে থাকি। কিন্তু অনেকেই উপমা, অলংকার এবং অনুপ্রাস কাকে বলে তাই জানি না। জানি না উপমান এবং উপমিত। ফলশ্রুতিতে এসবের সঠিক ব্যবহারে আমরা প্রায়শই ভুল করে থাকি। অসামঞ্জস্য উপমা, অলংকার এবং অনুপ্রাসের ব্যবহার করার ফলে কবিতা হয়ে উঠে সাক্ষাৎ দুর্বধ্যতা দোষে দুষ্ট। অগোছালো। যা পাঠ করার সময় বোদ্ধা পাঠক মাত্রই তার হৃদয়ে একটি বড় ধাক্কা খান। ফলশ্রুতিতে সেইসব কবিতা কেতাদুরস্ত হয় না। সার্থক কবিতা তো আরও অনেক দূরের বিষয়। মোটকথা এসব বিষয়ে আমাদের আরও ভালোভাবে যেমন জানা উচিত; তেমনি আমাদের প্রয়োজন কিছু ব্যাকরণগত জ্ঞান। বাংলা ব্যাকরণের যথার্থ জ্ঞান ছাড়া আপনার-আমার লেখায় ভুল-ত্রুটি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তাই আমি মনে করি, সার্থক কবিতা লিখতে হলে যথার্থ ভাষাগত জ্ঞান থাকা একজন কবির জন্য অপরিহার্য। একজন কবি যেমন প্রমিত বাংলা ভাষা জানবেন, তেমনি জানবেন আঞ্চলিক বা কথ্য ভাষাও। সাধু এবং চলিত রীতির পার্থক্য না জানলে কবিতা গুরুচাণ্ডালী দোষে দুষ্ট হতে বাধ্য। যথাযথ ভাষাগত জ্ঞানের অভাবে বাহুল্য দোষসহ অন্যান্য আরও দোষে দুষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলশ্রুতিতে সার্থক কবিতা সুদূর পরাহতই থেকে যাবে। তবে নিজের ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভের পাশাপাশি বিদেশি ভাষায় দক্ষতাও আপনার জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক বিষয় হবে বলে আমি মনে করি। অবশ্য কেউ কেউ আমার এ মতের বিরোধিতাও করতে পারেন। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ভাষা একটি গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল বিষয়। নদীর স্রোতের মতোই ইহাকে এক জায়গায় আটকে রাখা সম্ভব নয়। তাই বিদেশি শব্দের কাঙ্ক্ষিত এবং বঞ্চিত অনুপ্রবেশ দোষের কিছু নয়। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে বিদেশি শব্দের এই ব্যবহার হবে যৌক্তিক এবং কাঙ্ক্ষিত। যা কবিতার মাধুর্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আবার অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে উদ্দেশ্য যেন ব্যাহত না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে সার্থক কবিতার আর একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল বিষয়বস্তু। বিষয়বস্তুর চমৎকারিত্ব এবং বৈচিত্র্য কবিতাকে পাঠকের হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করায়। তবে সার্থক কবিতার কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু নেই। হতে পারে প্রেমের কবিতা। আবার হতে পারে নস্টালজিক, স্বদেশপ্রেম, মিলন কিংবা বিরহ, হতে পারে প্রকৃতির কবিতা, মানবতার কবিতা, বিদ্রোহী কবিতা ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন তা অবশ্য অবশ্যই সমসাময়িক হলে ভালো হয়। যে কবিতা সময়-কে ধারণ করে, লালন করে, পালন করে সেই কবিতা অবশ্যই সচেতন পাঠকের সপ্রশংস দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস।
সর্বোপরি আমাদেরকে কবিতা লেখায় যত্নশীল হতে হবে। আরও আন্তরিক হতে হবে। বাংলা সাহিত্যসহ বিশ্বসাহিত্য পড়তে হবে। নিজেকে খুব বড় কবি না ভেবে কবিতার একজন ছাত্র ভাবতে হবে। আপনার সব কবিতাই সার্থক হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, সারাজীবন কবিতা লিখে যদি আমার একটি কবিতা অথবা একটি কবিতার অংশ বিশেষ সুধীমহলে স্বীকৃতি লাভ করে তাহলেই লেখক জীবন সার্থক। বিখ্যাত কবিদের দিকে তাকিয়ে দেখুন, আমরা তাদের কয়টি কবিতার নাম বলতে পারি? হয়ত কারো একটি, কারো দুটি, তিনটি কিংবা বড়জোর চার কি পাঁচটি! ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব কিংবা পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি.... এইরকম লাইন খুব বেশি দরকার নেই। এক, দুটি হলেই যথেষ্ট!
প্রিয় পাঠক, হতাশা নয়। আসুন, আশাবাদী মানুষ হই। আসুন, কবিতাকে ভালোবাসি। ভালোবেসে কবিতা লিখতে থাকি। লিখতে লিখতে একদিন দেখবেন আপনার আমার কলম দিয়েও সার্থক কবিতার জন্ম হয়েছে।