এক.
বিশাল সাইজের গোলগাল, নাদুসনুদুস চাঁদ উঠেছে পূবাকাশে। সচরাচর এমন চাঁদ আমার চোখে লাগেনি আগে। অবশ্য ঢাকা শহরের আকাশে এমন পরিপুষ্ট চাঁদ কারও চোখেই পড়ার কথা না। নেত্রকোনার আকাশ যেন ভিন্ন, ঢাকার আকাশের মতো না! খোলামেলা, পরিপাটি! বাসা থেকে বেরিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে থানার মোড়ে এলাম। কিছুক্ষণ মগরা নদীর উপর লোহার জরাজীর্ণ ব্রিজের রেলিং ধরে জিরিয়ে নিলাম। নদীতে বেশ জল এবং স্রোত। জলের জমিনে চাঁদের উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব। ব্রিজের বাম দিকে যে রাস্তা চলে গেছে সেদিকে কিছুটা গেলেই কাকলিদের বাসা। অনেকবার গিয়েছি সেই বাসায়। জলের দিকে তাকিয়ে মনে পড়লো নির্মলেন্দু গুণের কবিতার লাইন-
‘সেই বাসন্তী, আহা সেই বাসন্তী এখন বিহারে
ডাকাত স্বামীর ঘরে চার সন্তানের জননী হয়েছে!’
তারপর ফের হাঁটতে হাঁটতে মাছবাজারের দিকে রওনা দিলাম। হাতের বাম দিকে চোখে পড়লো জেলা বিএনপি অফিস। সুন্দর, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সারিবদ্ধভাবে অনেক চেয়ার সাজানো। টেবিলের ওপাশে নেতৃস্থানীয়রা বসে আছে, এপাশে অনেক কর্মী-সমর্থক। এই দৃশ্য গত পনেরো বছরে কদাচিৎ দেখা গেছে। তারও আগে ছোটবাজারে অবস্থিত জেলা আওয়ামী লীগের তিনতলা অফিস হাতের বাম দিকে ফেলে এসেছি। অফিসের সাইনবোর্ড পুড়ে গেছে কিংবা খুলে নেওয়া হয়েছে। নিচতলা থেকে শুরু করে পুরো ভবনে আগুনের ধ্বংসাবশেষ। মনে হলো ইউক্রেন যুদ্ধের কথা। রাশিয়া বুঝি এখানে উপর্যুপরি বিমান হামলা করেছে! এই করুণ পরিণতি, এই দুঃসহ চিত্র ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বিগত স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পরপরই সারা দেশের পার্টি অফিসের, নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরের।
গ্রামের বাড়িতেও গিয়েছিলাম। সেখানে তিনদিন ছিলাম। চারপাশের বর্ষার জল কমে গেছে। সবাই এখন ভাদ্র মাসের ধানের চারা লাগাতে ব্যস্ত জমিতে। সকাল থেকে সন্ধ্য অবধি ক্ষেতে তাদের কাজ। সন্ধ্যার পর সড়কের মোড়ে টং দোকানে আড্ডা বসে। আমিও চুপচাপ সেই আড্ডায় শামিল হই। কয়লার ইঞ্জিনের মতো বিড়ির ধোঁয়া বের হচ্ছে সবার মুখ থেকে। জমে উঠে তাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক আলাপ। কোথাও কোনো আক্ষেপ নেই বিগত সরকার প্রধানের জন্য। কেবল ক্ষোভ, ঘৃণা আর ছি-ছি! কেউ একজন হাসিমুখে আমার দিকে একটা বিড়ি বাড়িয়ে দেয়। আমিও হাসিমুখে বলি- আমি বিড়ি-সিগারেট টানি না।
উপস্থিত মজমায় সবার একটাই কথা- ‘অহন এ্যাই সরহারই থাউক। আর্মি দিয়া বাইড়াইয়া ফুটকির চামড়া তুইল্যা লাউক।’ আমি কিছু বলি না। আমার শুনতে বেশ লাগে তাদের এই রাজনৈতিক বয়ান এবং ইচ্ছের কথা। গ্রামের সাধারণ প্রান্তিক জীবনে এই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি কোনো আশা, কোনো শ্রদ্ধা, কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।
দুই.
তিনদিন ধরে মোহনগঞ্জ থেকে বাল্যবন্ধু বিধান এসেছে বাসায়। তার বউ টানা পাঁচ বছর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতি এলাকায় থাকা তার জন্য খুবই অনিরাপদ এখন। তাকে আশ্বস্ত করলাম- তিন মাস থাকলেও আমার কোনো সমস্যা নেই। আম্মা বাসায় আছে। তিনবেলা রান্না করে দিবে, তুই আর আমি খাবো। আর এই ক্রান্তিকালে তুই বিগত পনেরো বছরের তোর রাজনৈতিক ভুল নিয়ে আত্মসমালোচনা করবি। অনেকটা যেন বাইবেলে বর্ণিত কনফেশনের মতো! আমার এই কথায় বিধান সিগারেটে শেষটান দিয়ে শুকনো হাসি দেয়। সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে সে চোখ বন্ধ করে বাইবেলের সেই লাইনগুলো বলতে থাকে- ‘If we confess our sins, He is faithful and just and will forgive us our sins and purify us from all unrighteousness.’
আমি অবাক হয়ে বললাম- তোর মেমোরি খুব শার্প। একটা সময় তুই প্রচুর পড়াশোনা করতি। কিন্তু এই অপরাজনীতি তোর সেই সুকুমারবৃত্তি নিংড়ে নিয়েছে! বিধান আরেকটা সিগারেট ধরায়। ধোঁয়ার রিং আমার মুখের দিকে নিক্ষেপ করে বলে- আমরা ছিলাম তৃণমূলের নেতা-কর্মী। গত পনেরো বছরে দলের ভেতর আমাদের মত মানুষের কোনো মতামত দেওয়ার কোনো অধিকার ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছিল ভয়ংকর সব চাটুকারের দল! এরা কি কখনো নেত্রীকে আসল কথাটা বলেছে? নাকি উনাকে মিথ্যা বলে বলে চূড়ান্ত বিভ্রান্তির ভেতর রেখেছিলো? এই চাটার দল বঙ্গবন্ধুকেও সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, বঞ্চনা, কষ্টের কথা জানতে দেয়নি, তেমনি আজকের প্রধানমন্ত্রীকেও দেয়নি। এদের মুর্খামি, নির্বুদ্ধিতা, হঠকারিতায় সরকার, সরকারপ্রধান চরম বিব্রত আর ভয়াবহ বিপদগ্রস্ত। এই চাটারের দল ভেবেছে- এই দেশের আঠারো কোটি মানুষই আওয়ামী লীগ করে, দেশের সাধারণ মানুষের ভেতর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, কষ্ট নেই, সরকারের প্রতি মানুষের কোনো রাগ-ক্ষোভ নেই, দ্রব্যমূল্য নিয়ে দেশবাসীর একবিন্দু অভিযোগ নেই, দুর্নীতি নিয়ে কারো কোনো কথা নেই। এই দেশ যেন একটা রূপকথার দেশ! এরা নেত্রীকে আরও বুঝিয়েছে- যে শিশুটা আজকে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, সেও মুজিবকোট পরে মায়ের পেট থেকে বেরিয়েছে! কিন্তু এখন নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে- আওয়ামী লীগ করা, আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেওয়া সকল শ্রেণির মানুষ এই সরকারের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে গেছে। এর দায় কিন্তু এইসব চাটুকারদের। অথচ যদি দেওয়ালে কান পাততো, যদি এইসব তরুণ প্রজন্মের ভেতরটা দেখার, বোঝার চেষ্টা করতো তাহলে আজকে এই পরিণতি হতো না। ছি:, চাটারের দল! এদের জন্যই সরকারের এই পতন, এদের জন্যই সরকারপ্রধানের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া!
এই ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের বাংলাদেশ ভিন্ন হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কাছে বাংলাদেশের গতানুগতিক রাজনীতি আর রাজনৈতিক দলগুলোর কোনোটাই আর নিরাপদ নয়- এই সত্যিটা মাথায় রেখেই পরিবর্তিত বাংলাদেশে সব দল এবং নেতাকে রাজনীতি করতে হবে। নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের ‘পালস’ বুঝেই এখন রাজনীতি করতে হবে। জনগণের উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দিয়ে, মুখ বন্ধ করে, তাদের মৌলিক অধিকার হরণ করে, দুর্নীতি, লুটপাট আর দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেট লালন করে এই দেশে আর কোনো দলই রাজনীতি করতে পারবে না। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান সেই বার্তাই সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে, তাদের নেতাদেরকে দিয়েছে।
আমি বিধানের কথা কিংবা বলা যায় এই সুন্দর, সহজ স্বীকারোক্তির সাথে একমত পোষণ করে বললাম, পরিস্থিতি শান্ত এবং স্বাভাবিক হলে যার যার মতো করে নিজ দলের অন্যায়, সরকারের অন্যায় এবং ভুলগুলো প্রকাশ্যে দেশবাসীর সামনে বলা শুরু করতে হবে। তুই যেমন এখন করছিস। তর্কে না জড়িয়ে আত্ম-সমালোচনা করা শুরু করতে হবে- কেন এই পতন? কেন এই জনরোষ? কেন সাধারণ মানুষের, কেন সাধারণ ছাত্রদের, কেন এই তরুণ প্রজন্মের এতো ক্ষোভ, ঘৃণার প্রকাশ ঘটলো? এইসব কারণ অনুসন্ধান করতে হবে দলের প্রতিটি নেতা-কর্মীর। দেশবাসীর কাছে নিজের দোষ, নিজের ভুল, নিজের অপরাধ স্বীকার করা দোষের কিছু নয়। বরং এখনও ‘আমরাই সঠিক ছিলাম, আমাদের কোথাও কোনো ভুল নেই’ কিংবা ‘ছাত্র-জনতা কিছু না, আমরাই সব’-- এই মনোভাব সাধারণ জনগণকে বোঝালে নিজেদেরকে আরও বেশি ঘৃণ্য এবং পরিত্যক্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। নিজেদের অস্তিত্ব চরম সংকটে পড়বে।
তিন.
ভেতর থেকে আম্মা ডাকছে-- টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাচ্ছে। তোরা তাড়াতাড়ি খেয়ে যা। আমি আর বিধান হাতমুখ ধুয়ে দ্রুতই খাবার খেতে বসলাম। খাবারের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের কথা চলতেই থাকে। আমার চেয়ে বিধানই বেশি বলে যাচ্ছে। আসলে সে দলের একজন নিবেদিত কর্মী। তার কষ্টটা তাই বেশি। সে ভাতের নলা মুখে দিয়ে বললো- যে যা-ই বলুক, দেশের এই অবস্থা, দলের এই অবস্থার জন্য মূলত নেত্রীই দায়ী! উনার একঘেয়েমি মনোভাব আর দাম্ভিকতার কারণেই আজকের এই পরিণতি! উনার কার্যকলাপের কারণেই উনি জনবিচ্ছিন্ন এবং ফ্যাসিস্ট শাসকে পরিণত হয়েছিলেন! ভাবতে অবাক লাগে- আওয়ামী লীগের কী করুণ পরিণতি আজ! এতো বড় বিপর্যয়ের পরও দলটি তার সাধারণ নেতা-কর্মী, সাধারণ মানুষের উপর আস্থা রাখতে পারছে না। তারা আশায় আছে ভারত একটা ‘সমাধান’ দিবে! এতোটাই দেউলিয়া হয়েছে পঁচাত্তর বছরের পুরাতন একটি রাজনৈতিক দল, যার হাত দিয়ে দেশের স্বাধীনতা এসেছে! এখনো একবিন্দু অনুশোচনা নেই, একবিন্দু আত্ম-সমালোচনা নেই, একবিন্দু দেশের মানুষের কাছে ভুল স্বীকার করা নেই! মনে হচ্ছে দেশের জনগণকে বুঝি আওয়ামী লীগ তার প্রতিপক্ষ ভাবে, শত্রু ভাবে। অথচ যেকোনো রাজনৈতিক দলের একমাত্র প্রধান শক্তি তার দেশের জনগণ। আসলে অন্ধ হলেও প্রলয় কি বন্ধ থাকে? থাকে না!
আমার খাওয়া শেষ। হাসিমুখে বিধানকে তাড়া দিই-- বাদ দে, তোকে আর কনফেশন করতে হবে না। যথেষ্ট হয়েছে! এবার ঝটপট খেয়ে উঠে পড়। তবে তোর এই আত্মোপলব্ধি দলের উপরের স্তরের নেতাদের ভেতর সঞ্চারিত হোক, তারা দেশবাসীর কাছে কনফেশন করুক। তাতে তো দলেরই লাভ। দলের গ্রহণযোগ্যতা জনগণের কাছে বাড়বে, দল যারা চালায় তারা এই কনফেশনের মধ্য দিয়ে পরিশুদ্ধ হবে। বিধান খাওয়া শেষ করে হাতমুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। মিনিটখানেক বাইরে আনমনে তাকিয়ে থেকে নীরবে একটা সিগারেট ধরালো। তার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, সে এখন অনেকটাই যেন নির্ভার, গ্লানিমুক্ত!